North Sentinel Island: ভারতের আন্দামান সাগরের বুকে অবস্থিত নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড শুধুমাত্র একটি দ্বীপ নয়, এটি যেন সময়ের স্রোতে আটকে পড়া এক জীবন্ত ইতিহাস। আধুনিক বিশ্বের কোলাহল, প্রযুক্তি এবং সভ্যতার আলো থেকে শত শত মাইল দূরে এই দ্বীপটি এক অক্ষত রহস্যের চাদরে মোড়া। এখানে বসবাসকারী সেন্টিনেলি জনগোষ্ঠী পৃথিবীর সেই বিরলতম প্রজাতিদের মধ্যে অন্যতম, যারা হাজার হাজার বছর ধরে বাইরের জগৎ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে।
সভ্যতার বাইরে এক পৃথিবী
নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলো এখানকার জীবনযাত্রা। এখানে বসবাসকারী সেন্টিনেলিরা আজও সেই প্রাচীন যুগেই বাস করে, যা আমাদের কাছে কেবলই ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ। তাদের জীবনে নেই কোনো আধুনিক প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ বা উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাদের জীবন ধারণের পদ্ধতি অনেকটা পাথর যুগের মানুষের মতো, যেখানে শিকার এবং বন থেকে ফলমূল সংগ্রহই মূল ভিত্তি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই জনগোষ্ঠী প্রায় ৬০,০০০ বছর ধরে এই দ্বীপেই একইভাবে জীবনযাপন করে আসছে, যা তাদের পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো এবং বিচ্ছিন্ন জীবন্ত সভ্যতা হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।
বাইরের জগতের প্রতি তীব্র প্রতিরোধ
এই দ্বীপটিকে বিপজ্জনক বলার মূল কারণ হলো সেন্টিনেলিদের মনোভাব। তারা বাইরের জগতের কোনো মানুষকে বন্ধু হিসেবে দেখে না, বরং শত্রু হিসেবেই গণ্য করে। তাদের এই মনোভাবের কিছু বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করা হলো:
- তৎক্ষণাৎ আক্রমণ: কোনো নৌকা, জাহাজ বা হেলিকপ্টার দ্বীপের কাছাকাছি এলেই সেন্টিনেলিরা তির-ধনুক নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ করে। তাদের তিরের নিশানা অব্যর্থ এবং তা মুহূর্তেই প্রাণঘাতী হতে পারে।
- সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা: তারা বাইরের কোনো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে চায় না। অতীতে বহুবার চেষ্টা করা হলেও তারা উপহার বা বন্ধুত্বের হাত ফিরিয়ে দিয়েছে তীব্র আক্রোশের সঙ্গে।
- আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি: বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি তাদের হিংস্রতা নয়, বরং নিজেদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বকে বাইরের পৃথিবীর প্রভাব থেকে রক্ষা করার একটি চরম প্রচেষ্টা।
সরকারি সুরক্ষা ও ভবিষ্যৎ
ভারতীয় সরকার সেন্টিনেলিদের এই বিচ্ছিন্নতা এবং স্বাধীনতাকে সম্মান জানায়। তাদের জীবনধারা এবং সংস্কৃতিকে সুরক্ষিত রাখতে দ্বীপের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্ত প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই কঠোর নিয়মের প্রধান উদ্দেশ্য হলো:
- সেন্টিনেলিদের রক্ষা: আধুনিক বিশ্বের রোগজীবাণুর সংস্পর্শে এলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে, কারণ তাদের শরীরে সেইসব রোগের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই।
- প্রাচীন সংস্কৃতি সংরক্ষণ: তাদের হাজার হাজার বছরের পুরনো জীবনধারাকে অক্ষত রাখা এবং কোনোভাবেই তাদের জীবনে হস্তক্ষেপ না করা।
নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড এক চলমান রহস্য, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে এই পৃথিবীতে এখনও এমন স্থান রয়েছে যেখানে প্রকৃতি এবং প্রাচীন মানব সভ্যতা নিজেদের নিয়মেই চলে। এটি যেন সময়ের এক বন্ধ দরজা, যার ওপারে এক অন্য পৃথিবী আজও নিঃশ্বাস নিচ্ছে।


