Kolkata Alpana Art: শহর কলকাতা যখন উৎসবের আলোয় সেজে ওঠে, তখন এক অন্যরকম তুলির টানে তার ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলেন ৭৩ বছর বয়সী রত্নাবলী ঘোষ। গত তিন বছর ধরে, তিনি কলকাতার রাস্তা ও অলিগলিতে আলপনা এঁকে চলেছেন, যা একসময় বাংলার প্রতিটি বাড়ির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। তাঁর এই একক প্রচেষ্টা শুধু একটি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখছে না, বরং শহরবাসীর মনে সংস্কৃতির প্রতি এক নতুন ভালোবাসা জাগিয়ে তুলছে।
প্রতি বছর কালী পূজা এবং দীপাবলির আগে, রত্নাবলী দেবী এবং তাঁর এক সহকারীকে দেখা যায় শহরের পথে। খুব ভোরে উঠে তাঁরা বেরিয়ে পড়েন লেক মার্কেট এবং প্রতাপাদিত্য রোডের মতো এলাকায়। একের পর এক বাড়ির চৌকাঠে ফুটে ওঠে তাঁদের হাতের জাদুতে অপূর্ব সব নকশা। এই বয়সেও তাঁর এই উদ্যোগের পিছনে রয়েছে এক অকৃত্রিম ইচ্ছা – বাংলার এই ঐতিহ্যকে সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়া। তাঁর নিজের কথায়, “আমি চাই মানুষ আল্পনা থেকে আনন্দ অনুভব করুক।” এই আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়াই তাঁর মূল প্রেরণা।
শিল্পের উত্তরাধিকার এবং অনুপ্রেরণা
রত্নাবলী ঘোষের এই শৈল্পিক দক্ষতার উৎস তাঁর পারিবারিক উত্তরাধিকার। তাঁর মা, প্রতিভা সেনগুপ্ত, ছিলেন শান্তিনিকেতনের কিংবদন্তী শিল্পী নন্দলাল বোসের সরাসরি ছাত্রী। মায়ের কাছ থেকেই তিনি আলপনার এই সূক্ষ্ম নৈপুণ্য এবং শৈলী শিখেছেন। ছোটবেলা থেকে পাওয়া এই শিক্ষা তাঁর মনে গেঁথে ছিল।
দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে তিনি শিক্ষকতার মতো এক মহান পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর, শিল্পের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এক নতুন রূপ পেয়েছে। তিনি তাঁর শিল্পকে শ্রেণীকক্ষের চার দেওয়ালের বাইরে এনে শহরের রাজপথে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত শখের প্রকাশ নয়, বরং বাঙালির সংস্কৃতিকে প্রকাশ্যে উদযাপন করার এক অনবদ্য প্রয়াস।
এলাকাবাসীর চোখে রত্নাবলী
রত্নাবলী দেবীর এই কাজ এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে এক অপার বিস্ময় ও গর্বের সঞ্চার করেছে। শিশু থেকে শুরু করে অচেনা পথচারী, সকলেই তাঁর কাজে মুগ্ধ। যে রাস্তা দিয়ে তারা প্রতিদিন যাতায়াত করে, সেই পরিচিত পথ যখন আলপনার ছোঁয়ায় নতুন রূপ পায়, তখন তাদের মনেও এক নতুন গর্ববোধ জন্মায়। তাঁর তুলির টানে শুধু রাস্তা নয়, মানুষের মনও রঙিন হয়ে ওঠে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আশা
তাঁর এই প্রচেষ্টা থেমে থাকার নয়। এই বছর তিনি প্রায় ১০টি বাড়ির উঠোন আলপনা দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন। তবে তাঁর লক্ষ্য আরও বড়। আগামী বছরগুলিতে এই শিল্পকে আরও বেশি এলাকায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। রত্নাবলী দেবী চান, এই প্রথা যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে। তাঁর আন্তরিক আশা:
- ঐতিহ্য রক্ষা: “বাংলার এই ঐতিহ্য যেন কালের গহ্বরে বিলীন না হয়ে যায়।”
- প্রজন্মের প্রতি বার্তা: তিনি চান, “মানুষ যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম একে এগিয়ে নিয়ে যায়।”
- অনুপ্রেরণা: তাঁর এই কাজ যেন কলকাতাকে আরও সুন্দর করে তুলতে অন্যদের অনুপ্রাণিত করে।
রত্নাবলী ঘোষ শুধু একজন শিল্পী নন, তিনি একজন সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাঁর তুলির প্রতিটি আঁচড়ে লুকিয়ে আছে বাংলার ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, যা আগামী প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।


