Himalayas Formation: আমরা সকলেই জানি যে হিমালয় পর্বতমালা বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের ঠিকানা। কিন্তু যদি বলা হয়, এই সুবিশাল পর্বতমালার অস্তিত্ব একদিন সমুদ্রের গভীরে ছিল, আপনি কি বিশ্বাস করবেন? অবিশ্বাস্য মনে হলেও, ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ কিন্তু এই কথাই বলে। প্রায় ৬ কোটি বছর আগে এক অভাবনীয় প্রাকৃতিক ঘটনার মধ্যে দিয়েই জন্ম হয়েছিল আজকের হিমালয়ের। চলুন, এই প্রতিবেদনে আমরা হিমালয়ের জন্ম-রহস্যের গভীরে প্রবেশ করি।
পৃথিবীর ছাদের জন্মকথা: তেথিস সাগরের উত্থান
আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি বছর আগের কথা। পৃথিবীর মানচিত্র আজকের মতো ছিল না। সেই সময় ভারতীয় ভূখণ্ড বা ভারতীয় প্লেট (Indian Plate) ছিল দক্ষিণ গোলার্ধের বিশাল মহাদেশ গন্ডোয়ানার একটি অংশ। কিন্তু ভূ-গর্ভস্থ শক্তির কারণে এই ভারতীয় প্লেট গন্ডোয়ানা ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উত্তরের দিকে প্রতি বছর কয়েক সেন্টিমিটার করে এগোতে শুরু করে।
সেই সময় আজকের ভারত ও ইউরেশিয়ার মাঝখানে ছিল এক বিশাল প্রাচীন সমুদ্র, যার নাম তেথিস সাগর (Tethys Sea)। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে নদী বাহিত পলি, বালি এবং সামুদ্রিক প্রাণীর দেহাবশেষ এই সাগরের তলদেশে জমা হচ্ছিল। ভারতীয় প্লেট যখন তার দীর্ঘ যাত্রা শেষে উত্তরের ইউরেশীয় প্লেটের (Eurasian Plate) সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খায়, তখন এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে।
মহাসংঘর্ষ এবং হিমালয়ের সৃষ্টি
দুই বিশাল ভূখণ্ডের এই সংঘর্ষ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তাদের মাঝখানে থাকা তেথিস সাগরের তলদেশে জমে থাকা নরম পলির স্তর ভাঁজ হয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। ঠিক যেমন একটি কাগজের দুই প্রান্ত থেকে চাপ দিলে সেটি মাঝখান থেকে উঁচু হয়ে যায়, তেথিস সাগরের তলদেশের পলল ও অবক্ষেপও ঠিক সেভাবেই উপরে উঠে আসে। এই প্রক্রিয়াতেই ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় বিশ্বের নবীনতম ভঙ্গিল পর্বতমালা— আমাদের গর্বের হিমালয়। এই ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াটি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলেছিল এবং আজও চলছে।
এক “জীবন্ত” পর্বতমালা
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেটের এই সংঘর্ষ আজও থেমে যায়নি। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, ভারতীয় প্লেট এখনও প্রতি বছর প্রায় কয়েক সেন্টিমিটার করে উত্তর-পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে এবং ইউরেশীয় প্লেটের নিচে প্রবেশ করছে। এই অবিরাম চাপের ফলেই হিমালয় পর্বতমালা আজও ধীরে ধীরে উঁচু হচ্ছে। একারণেই হিমালয়কে একটি “বেঁচে থাকা” বা সক্রিয় পর্বতশ্রেণি বলা হয়। এর উচ্চতা বৃদ্ধি হয়তো খালি চোখে বোঝা সম্ভব নয়, কিন্তু ভূতাত্ত্বিক সময়কালের নিরিখে এটি একটি চলমান এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
পাথরের বুকে অকাট্য প্রমাণ
হিমালয়ের উৎপত্তির এই তত্ত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ লুকিয়ে আছে তার পাথরের মধ্যেই। পর্বতারোহী এবং বিজ্ঞানীরা হিমালয়ের বিভিন্ন উচ্চতায় এমন অনেক পাথর খুঁজে পেয়েছেন, যেখানে সামুদ্রিক শামুক, প্রবাল এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবাশ্ম (Fossils) স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এই জীবাশ্মগুলোই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, আজকের আকাশছোঁয়া পর্বতশৃঙ্গগুলো একসময় তেথিস সাগরের গভীর তলদেশে বিশ্রাম নিত। এই প্রমাণগুলি হিমালয়ের সামুদ্রিক অতীতকে সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করে।
সুতরাং, পরের বার যখন আপনি হিমালয়ের ছবি দেখবেন বা তার গল্প পড়বেন, তখন মনে রাখবেন যে এটি শুধু পাথর আর বরফের স্তূপ নয়, এটি কোটি কোটি বছরের এক অবিশ্বাস্য ভূতাত্ত্বিক যাত্রার জীবন্ত সাক্ষী, যা একদা ছিল সমুদ্রের অংশ।


